রক্তাক্ত স্মৃতি: ১৯৭১-এর রমনা গণহত্যা—নিরীহ প্রাণের নির্মম বিসর্জন

1/31/20251 min read

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ রাতটি কেবল আরেকটি তারিখ ছিল না। এটি ছিল সেই বিভীষিকাময় রাত, যখন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী নির্মমভাবে রমনা কালী মন্দিরের চারপাশে বসবাসরত নিরীহ হিন্দুদের হত্যা করেছিল। রমনা গণহত্যা—যে শব্দটি শুনলেই মন বিষাদে ভরে ওঠে, হৃদয়ে কষ্টের স্রোত বইতে শুরু করে। সেই রাতে হিন্দুদের ওপর যে নারকীয় অত্যাচার নেমে এসেছিল, তা ইতিহাসের বুকে রক্তাক্ষরে লেখা হয়ে গেছে।

রমনা কালী মন্দির এবং তার আশেপাশের গ্রামটি ছিল একটি শান্তিপূর্ণ হিন্দু পল্লী। হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিকতার সাক্ষী এই গ্রামে প্রায় ২০০০ হিন্দু পরিবারের বসবাস ছিল। পুরান ঢাকার দাঙ্গায়ও অক্ষত থাকা এই পল্লী ছিল ভক্তদের নির্ভয়ে আশ্রয়স্থল। কিন্তু একাত্তরের সেই কালো রাত সবকিছু বদলে দেয়।

সেই রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা বন্দুক, কামান আর মেশিনগানের গর্জনে মন্দির এবং আশ্রম ধ্বংস করে দেয়। নিরপরাধ মানুষদের গুলি করে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। পুরোহিত পরমানন্দ গিরি এবং অসংখ্য ভক্তদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কিছু পুরুষ ও মহিলাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে একের পর এক ‘কালেমা’ পাঠ করিয়ে তাদের পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়। মনে হয়েছিল, যেন মানবতার সমস্ত আলো নিভে গিয়েছিল সেই রাতের অন্ধকারে।

নারীরা তাদের শাঁখা ভেঙে ফেলেছিলেন, সিঁদুর মুছে ফেলেছিলেন, যেন নিজেদের জীবন বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেদিন কোনো চেষ্টা আর কাজে আসেনি। তারা নিজের চোখের সামনে প্রিয়জনদের লাশের স্তূপ দেখেছিলেন, যারা হয়তো কয়েক মিনিট আগে পর্যন্ত জীবনের আশায় মুখে হাসি ধরে রেখেছিলেন। আর সেই হাসি নিভে গিয়ে রমনা কালী মন্দিরের চারপাশে মৃত্যুর নীরবতা নেমে এসেছিল।

পাকিস্তানি বাহিনীর সেই হামলার পর ভোরবেলা যারা বেঁচে ছিলেন, তারা ছিলেন ভয়, আতঙ্ক, এবং অসীম কষ্টের মধ্যে। তারা বুঝে উঠতে পারেননি যে, এক পবিত্র মন্দির এত নির্মমভাবে ধ্বংস হতে পারে। পুরোহিত পরমানন্দ গিরি তাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই রাত প্রমাণ করে দিলো যে, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা যতই পবিত্র হোক না কেন, নির্মমতার হাতে তা কখনো রেহাই পায় না।

এই গণহত্যার পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও রমনা কালী মন্দিরের সেই রাতের বিভীষিকা আমাদের মন থেকে মুছে যায়নি। স্বাধীনতার পর সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়, যেখানে গণহত্যায় নিহত ৬৯ জনের নাম খোদাই করা রয়েছে।

রমনা গণহত্যার সেই কষ্টদায়ক স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলে আমাদের হৃদয়ে। সেই রাত্রির প্রতিটি মুহূর্ত যেন আজও বাতাসে ভেসে বেড়ায়, যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই নিষ্ঠুরতার কথা, সেই নিরপরাধদের আর্তনাদের কথা।

রক্তাক্ত স্মৃতি: ১৯৭১-এর রমনা গণহত্যা—নিরীহ প্রাণের নির্মম বিসর্জন