ভুলে যাওয়া শক্তি পীঠ: ইতিহাস, বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের অজানা যাত্রা

1/31/20251 min read

বাংলাদেশের শক্তি পীঠ: ইতিহাস, বিশ্বাস এবং ঐতিহ্য

বাংলাদেশের মাটিতে অবস্থিত বিভিন্ন শক্তি পীঠ হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান। এই সব শক্তি পীঠগুলি মূলত দেবী সতীর দেহের অংশ যেখানে যেখানে পড়েছিল, সেখানেই এই শক্তি পীঠগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শক্তি পূজার সাথে হিন্দু ধর্মের সংযোগ বহু পুরনো এবং এর সাথে জড়িয়ে আছে দেবী দুর্গা ও কালী পূজার আচার ও রীতি। বাংলাদেশে যে সমস্ত শক্তি পীঠ রয়েছে, সেগুলির পেছনে রয়েছে বিভিন্ন মিথ ও কাহিনী যা দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।

১. ভবানীপুর শক্তি পীঠ

স্থান: পাবনা জেলার ভবানীপুর
পতিত অঙ্গ: দেবী সতীর বাম হাঁটু
দেবী: অর্পণা (ভবানী)
ভৈরব: বামদেশ

ভবানীপুর শক্তি পীঠ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান, যা পাবনা জেলার অন্তর্গত। কথিত আছে যে এখানে দেবী সতীর বাম হাঁটু পতিত হয়েছিল। এটি একটি অত্যন্ত পুরাতন মন্দির এবং এই মন্দিরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে বহু পুরাণ কাহিনী। ভবানীপুর এলাকাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান যেখানে দেবী অর্পণার পূজা করা হয়।

এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে প্রায়শই বিভিন্ন পূজা ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে দুর্গাপূজার সময় এই মন্দিরে প্রচুর ভক্ত সমাগম ঘটে। ভবানীপুর শক্তি পীঠের প্রাচীনত্ব এবং ইতিহাস এই স্থানটিকে ধর্মীয়ভাবে আরও বিশেষ করে তুলেছে।

২. বোধেশ্বরী শক্তি পীঠ

স্থান: বোদা, পঞ্চগড়
পতিত অঙ্গ: দেবী সতীর গলা
দেবী: বোধেশ্বরী
ভৈরব: আম্বর

পঞ্চগড় জেলার বোদা এলাকায় অবস্থিত বোধেশ্বরী শক্তি পীঠ এক বিশেষ তীর্থস্থান যেখানে দেবী সতীর গলা পড়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। এই মন্দিরটি ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এবং প্রচুর সংখ্যক ভক্ত প্রতি বছর এখানে পূজার্চনা করতে আসেন।

বোধেশ্বরী শক্তি পীঠের চারপাশে রয়েছে শান্তিপূর্ণ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যা ভক্তদের মনকে শীতল করে। স্থানীয় কাহিনী অনুসারে, এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল অনেক বছর আগে এবং এই শক্তি পীঠের বিশেষত্ব হলো এর শান্ত পরিবেশ।

৩. যশোরেশ্বরী শক্তি পীঠ

স্থান: ঈশ্বরীপুর, সাতক্ষীরা
পতিত অঙ্গ: দেবীর পায়ের তালু
দেবী: যশোরেশ্বরী
ভৈরব: চন্দ্র

যশোরেশ্বরী শক্তি পীঠ বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার ঈশ্বরীপুরে অবস্থিত এবং এটি একটি অত্যন্ত প্রাচীন মন্দির। দেবী সতীর পায়ের তালু এই স্থানে পতিত হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। এই মন্দিরের নামের সাথে যশোর শহরের নাম সংযুক্ত হলেও মন্দিরটি সাতক্ষীরার অংশ। যশোরেশ্বরী মন্দিরটি অনেক পুরনো এবং বহু ভক্তদের তীর্থস্থান।

প্রতি বছর প্রচুর ভক্ত এখানে আসেন এবং মন্দিরে দেবীর পূজা করেন। বিশেষ করে নবরাত্রি এবং দুর্গাপূজার সময় মন্দিরের প্রাঙ্গণ ভক্তদের ভিড়ে ভরে ওঠে। যশোরেশ্বরী মন্দিরের প্রতিটি অংশে ইতিহাস এবং সংস্কৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়।

৪. সুগন্ধা শক্তি পীঠ (বরিশাল)

স্থান: শিকারপুর, বরিশাল
পতিত অঙ্গ: দেবীর নাসা
দেবী: সুনন্দা
ভৈরব: ত্র্যম্বক

সুগন্ধা শক্তি পীঠ বরিশালের শিকারপুর এলাকায় অবস্থিত, যেখানে দেবী সতীর নাসা পতিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এই মন্দিরটি বরিশালের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে এসে দেবী সুনন্দার পূজা করেন।

সুগন্ধা শক্তি পীঠের চারপাশে রয়েছে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং মন্দিরের পরিবেশ অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ। এখানে বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান যেমন নবরাত্রি ও দুর্গাপূজার সময় প্রচুর ভক্ত সমাগম ঘটে। সুগন্ধা মন্দির বরিশাল অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

৫. সীতাকুণ্ড শক্তি পীঠ (চট্টগ্রাম)

স্থান: সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম
পতিত অঙ্গ: দেবীর ডান হাত
দেবী: ভবানী
ভৈরব: চন্দ্রশেখর

সীতাকুণ্ড চট্টগ্রামের সবচেয়ে পরিচিত শক্তি পীঠগুলির মধ্যে একটি। কথিত আছে এখানে দেবী সতীর ডান হাত পতিত হয়েছিল এবং এখানে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটি সীতাকুণ্ড পাহাড়ের ওপর অবস্থিত। সীতাকুণ্ড শক্তি পীঠ বাংলাদেশের তীর্থযাত্রীদের জন্য অত্যন্ত প্রিয় স্থান এবং বহু ভক্ত এখানে পূজা করতে আসেন।

সীতাকুণ্ড শক্তি পীঠের সাথে জড়িয়ে রয়েছে অনেক পুরাণকথা এবং এটি একটি উল্লেখযোগ্য প্রাচীন মন্দির। সীতাকুণ্ড এলাকাটি দেবী ভবানী ও ভৈরব চন্দ্রশেখরের পূজা এবং আচার-অনুষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৬. কালাগুল শক্তি পীঠ (সিলেট)

স্থান: কালাগুল, সিলেট
পতিত অঙ্গ: দেবীর পায়ের আঙুল
দেবী: মহাকালী
ভৈরব: মহেশ্বর

সিলেটের কালাগুল শক্তি পীঠ দেবী সতীর পায়ের আঙুল যেখানে পড়েছিল সেই স্থান। এই মন্দিরে দেবী মহাকালীর পূজা করা হয় এবং এটি সিলেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। কালাগুল এলাকাটি ইতিহাস এবং আধ্যাত্মিকতার এক সমৃদ্ধ স্থান যা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিশেষভাবে প্রিয়।

প্রতি বছর এখানে নানা ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও পূজার্চনা অনুষ্ঠিত হয় এবং এটি একটি উল্লেখযোগ্য তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত হয়।

৭. কানাইঘাট শক্তি পীঠ (বামজংগা/জয়ন্তিয়া)

স্থান: কানাইঘাট, সিলেট
পতিত অঙ্গ: দেবীর ডান নিতম্ব
দেবী: কামাক্ষ্যা
ভৈরব: মহাভৈরব

কানাইঘাট শক্তি পীঠ সিলেটের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান যেখানে দেবী সতীর ডান নিতম্ব পড়েছিল বলে মনে করা হয়। এই মন্দিরটি সিলেটের পাহাড়ী অঞ্চলে অবস্থিত এবং এটি একটি বিশেষ তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। দেবী কামাক্ষ্যার পূজা এখানে বিশেষভাবে প্রচলিত এবং ভক্তরা প্রতি বছর এখানে এসে পূজার্চনা করেন।

৮. দক্ষিণ সুরমা শক্তি পীঠ

স্থান: দক্ষিণ সুরমা, সিলেট
পতিত অঙ্গ: দেবীর বাহু
দেবী: মহাশক্তি
ভৈরব: মহাদেব

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকায় অবস্থিত এই শক্তি পীঠটিতে দেবী সতীর বাহু পতিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।