মুলাদি হত্যাকাণ্ড: এক নির্মম অধ্যায়
1/31/20251 min read


মুলাদি নদীর বন্দর, এক সময় যার কোল ঘেঁষে বইত শান্তির বাতাস, ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারির সেই বিভীষিকাময় কয়েকটি দিন যেন সমস্ত কিছু বদলে দিল। এক অন্ধকার অধ্যায় শুরু হলো, যার সাক্ষী রইল হাজারো নিরীহ হিন্দু ও খ্রিস্টান, যাদের রক্তে রঞ্জিত হল মুলাদি বন্দর। ১৭ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি এই কয়েকটি দিন শুধু বরিশালের ইতিহাস নয়, বর্বরতার প্রতীক হয়ে রইল মানবতার ইতিহাসে।
ঢাকা থেকে ছড়ানো আগুনের শিখা
যখন ঢাকা গণহত্যার খবর বরিশালে পৌঁছল, তখনো কারও কল্পনাতেও ছিল না কী নরক আসন্ন। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই শান্তির আশ্বাসগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ১৪ ফেব্রুয়ারির সেই শান্তি সভার প্রতিশ্রুতি যেন এক নিছক মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে পরিণত হলো। তারপর ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হল একের পর এক আক্রমণ—কাজীরচর, কাশেরহাট, সাতানি গ্রাম। মদন নন্দী ও তাঁর ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হল। ডাক্তার প্রফুল্ল গায়েন আর কল্লোল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানুষরাও রেহাই পেলেন না এই নির্মমতার হাত থেকে।
যখন নির্যাতিত গ্রামবাসীরা ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় মুলাদি থানায় গেল, তখন ওসি তাদের বললেন মৃতদের দাহ করতে এবং সবাইকে বলতে, তারা রোগে মারা গেছে। এই কথাগুলো যেন গ্রামবাসীদের হৃদয়ে দগদগে এক ক্ষত তৈরি করে দিল। পুলিশের এই অবহেলা, এই নিষ্ঠুরতা যেন আকাশ বাতাস কাঁদিয়ে তুলল।
১৭ ফেব্রুয়ারি: রক্তের দাগ মুছবে কিভাবে?
১৬ ফেব্রুয়ারির রাত থেকে দূর থেকে ভেসে আসছিল "আল্লাহ হো আকবর" আর "কাফেরদের হত্যা কর" চিৎকার। প্রতিটি শব্দ যেন হিন্দু ও খ্রিস্টানদের মনে মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি বাজাচ্ছিল। ১৭ ফেব্রুয়ারির সকালে আতঙ্কিত মানুষ ছুটে চলল মুলাদি থানার দিকে, জীবন বাঁচানোর শেষ আশা নিয়ে। কিন্তু সেই থানা, যে তাদের রক্ষা করার কথা ছিল, সে দরজা বন্ধ করে দিল তাদের সামনে।
দুপুর ৩ টার দিকে ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ জনের এক বিশাল জনতা বন্দরে আক্রমণ করল। নিরস্ত্র মানুষগুলো প্রাণ বাঁচানোর জন্য দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু সেই দৌড় যেন এক অপ্রতিরোধ্য মৃত্যুর দিকে যাত্রা। একের পর এক পুরুষকে কেটে ফেলা হল, আর মহিলাদের চোখের সামনে তাদের সম্মান ছিনিয়ে নেওয়া হল। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলল এই বর্বরতা—হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট।
হৃদয়টা কেঁপে ওঠে যখন শোনা যায়, একটি সুপারি বাগানে ৩০০ টিরও বেশি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। যারা একসময় ছিল এই সমাজের প্রিয়জন, তারা আজ ইতিহাসের পাতায় শুধু একটি সংখ্যা হয়ে রইল।
১৮ ও ২০ ফেব্রুয়ারি: প্রতারণার শেষ অধ্যায়
১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে যারা বেঁচে ছিল, তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে ফিরে এল। তাদের হৃদয়ে বয়ে চলছিল একটুকরো আশা, হয়তো এখন কিছু হবে। সন্ধ্যায় তারা আবার থানায় জড়ো হল। এবার পুলিশ তাদের থেকে গহনা আর টাকা নিয়ে থানার ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিল।
এদিকে আনসার বাহিনী মুলাদিতে ঘোষণা করল, হিন্দুরা যেন থানায় জড়ো হয়। নিরীহ মানুষগুলো তখনও বিশ্বাস করেছিল যে হয়তো তারা বাঁচবে। কিন্তু তাদের সমস্ত আশা ভেঙে গেল যখন পুলিশ নিজের হাতে তাদের নির্যাতন শুরু করল—সিঁদুর ছিনিয়ে নেওয়া হল, মহিলাদের জোর করে কলমা পাঠ করতে বাধ্য করা হল। যারা একসময় স্বামী, সন্তান, ভাইদের স্নেহে ছিল, তারা আজ অচেনা পুরুষদের হাতে বিক্রি হয়ে গেল।
২০ ফেব্রুয়ারি আবার এক নতুন প্রতারণার ফাঁদ পাতল প্রশাসন। ঘোষণা এল যে বন্দরে ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে। বিশ্বাস করে সেই নিরীহ মানুষগুলো বন্দরের দিকে রওনা হল। তাদের তিনটি দলে ভাগ করে গুদামে রাখা হল। তারপর শুরু হল সেই রক্তাক্ত অধ্যায়ের শেষ পর্ব—৩,০০০ জনের সশস্ত্র জনতা আক্রমণ করল, ৭০০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করে তাদের দেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হল। বাকি মহিলাদের ভাগ করে নেওয়া হল।