কালশিরা হত্যাকাণ্ড: এক নিঃসঙ্গ রাতের আর্তনাদ
Blog post description.
1/31/20251 min read


কালশিরা হত্যাকাণ্ড: এক নিঃসঙ্গ রাতের আর্তনাদ
১৯৪৯ সালের ২০ ডিসেম্বর, এক শীতের রাত। খুলনার বাগেরহাটের মোল্লাহাট থানার অধীনে এক নিস্তব্ধ গ্রাম—কালশিরা। কেউ ঘুমিয়ে, কেউ হয়তো অর্ধেক ঘুমে। কিন্তু তখন কে জানত, সেই রাতই হয়ে উঠবে এক বিভীষিকাময় অধ্যায়, যে অধ্যায় লেখা হবে হাহাকার, রক্ত আর ধ্বংসের কালিতে।
রাতের শেষ প্রহরে পুলিশের চারজন কনস্টেবল এসে হাজির হলো জয়দেব বর্মের বাড়িতে। অভিযোগ—এখানে কমিউনিস্টরা লুকিয়ে আছে। কিন্তু তল্লাশি চালিয়েও তারা কাউকে খুঁজে পেল না। তবুও তারা ফিরে গেল না, ফিরে গেল তাদের মানবতার মুখোশ। তারা জয়দেবের স্ত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করল। এক নারীর চিৎকার, এক অসহায় প্রাণের করুণ আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ল রাতের অন্ধকারে।
এ আর্তনাদ আর সহ্য করতে পারলেন না জয়দেব ও তার আত্মীয়রা। ক্ষোভ, অপমান আর বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাদের হাতে অস্ত্র হয়ে উঠল। ধ্বংসযজ্ঞের শুরু সেখানেই। দুই কনস্টেবল আক্রমণের শিকার হল, এবং একজন প্রাণ হারাল।
প্রতিশোধের নামে নির্মম হত্যাযজ্ঞ
পরের দিন ভোর হতে না হতেই নেমে এল এক ভয়াল ঝড়। পুলিশ সুপার নিজে এলেন, সঙ্গে সশস্ত্র পুলিশ, আনসার বাহিনী। কিন্তু তারা কি ন্যায়বিচার করতে এসেছিল? না, তারা এসেছিল প্রতিশোধ নিতে।
কালশিরা যেন রক্তের নদীতে পরিণত হলো। আশপাশের হিন্দু গ্রামগুলোতেও নেমে এল ধ্বংসের কালো ছায়া। মুসলিম প্রতিবেশীদের উসকে দেওয়া হলো—লুট করো, জ্বালিয়ে দাও, হত্যা করো। নিষ্পাপ শিশু, বৃদ্ধ, নারী—কেউ রেহাই পেল না। ধর্মের নামে চলল বর্বরতার উৎসব। প্রতিমা ভাঙা হলো, মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হলো।
৩৫০টি হিন্দু বাড়ির মধ্যে মাত্র তিনটি টিকে ছিল। বাকিগুলো আগুনে পুড়ে, লুটপাটের শিকার হয়ে শূন্য হয়ে গেল। ঘরবাড়ি তো গেলই, প্রাণও গেল অগণিত। কেউ কেউ প্রাণ হাতে নিয়ে পালাল, কেউ আর পেরে উঠল না।
এক মাসের বিভীষিকা
একটি মাস—শুধু ৩০ দিন। কিন্তু এই ৩০ দিনে ৩০,০০০ হিন্দু বাধ্য হলো নিজেদের শেকড় ছেড়ে ভারতে পালাতে। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে, আপনজন হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে, পরিচিত মাটি ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াল তারা।
আজও কি আমরা শুনতে পাই সেই রাতের চিৎকার? আজও কি আমরা অনুভব করতে পারি সেই অসহায়ত্ব, সেই আতঙ্ক?
কালশিরা শুধু এক গ্রামের নাম নয়, এক বেদনার নাম, এক ইতিহাসের সাক্ষী। যেন এক দীর্ঘশ্বাস, যে বাতাসের সাথে মিশে গেছে, কিন্তু মুছে যায়নি। ইতিহাসের পাতায় লেখা রক্তের সেই দাগ কি আমরা ভুলে যাব? নাকি শিখব কিছু, ন্যায়বিচারের পথ খুঁজব, মানবতার দীপ জ্বালাব?
সময়ের কাছে এই প্রশ্ন রেখে যাই…