নোয়াখালী ও ফেনী জেলার হিন্দুদের ওপর ১৯৫০ সালের হত্যাকাণ্ড: এক ভয়াবহ ইতিহাস

1/31/20251 min read

নোয়াখালী ও ফেনী জেলার হিন্দুদের ওপর ১৯৫০ সালের হত্যাকাণ্ড: এক ভয়াবহ ইতিহাস

১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অন্ধকার অধ্যায়। নোয়াখালী এবং ফেনী জেলার হিন্দুদের ওপর যে বর্বরতা ঘটেছিল, তা শুধুমাত্র ইতিহাসের পৃষ্ঠা নয়, বরং মানবতার প্রতি এক অবর্ণনীয় আঘাত ছিল। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি আজও আমাদের হৃদয়ে গভীর দাগ রেখে গেছে।

১০ই ফেব্রুয়ারি, নোয়াখালী থেকে শুরু হওয়া এই হত্যাকাণ্ডের পর, মাত্র তিনদিনের মধ্যেই ১৩ই ফেব্রুয়ারি, ফেনী শহরের হিন্দুদের ওপরও এক ভয়াবহ আক্রমণ হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে, যেখানে পুলিশের এস.ডি.ও স্টেশন ও আদালত একে অপরের কাছাকাছি ছিল, সেখানে হিন্দুদের ওপর যে পাশবিক বর্বরতা চালানো হয়েছিল, তা শুধু মর্মান্তিক নয়, গভীরভাবে মানবিকতার পরাজয়।

ফেনী শহরের হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলো, যেমন মাস্টারপাড়া, উকিলপাড়া, ডাক্তারপাড়া, সহদেবপুর, বারাহীপুর, সুলতানপুর – সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মুসলিমদের আক্রমণে ঘর-বাড়ি, সম্পদ সব কিছু লুট হয়ে যায়, এবং বহু নিরীহ হিন্দু হত্যার শিকার হয়। সেখানকার হিন্দু সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, যেমন গুরুদাস কর, মুসলিমদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। এই বর্বরতার পরিসীমা ফেনী এবং ছাগলনাইয়া পুলিশ স্টেশন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছাই হয়ে যায়, নিরীহ মানুষগুলি প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করলেও তাদের প্রতি কোনো দয়া বা সহানুভূতি ছিল না।

একমাত্র বসতঘর বা সম্পদই নয়, নারীদের বিরুদ্ধে চলেছিল এক ভয়ংকর অপরাধের খেলা। মুসলিমরা হিন্দু মেয়েদের অপহরণ করেছিল, তাদের জোরপূর্বক বিয়ে করেছিল। একদিকে, হরেন্দ্রনাথ করের মেয়ে মিলা করকে সুলতান মিয়াঁ নামক এক সিভিল সাপ্লাই কন্ট্রাক্টর অপহরণ করে জোর করে বিয়ে করে, এবং তার চোখের সামনে তার বাবা, ঠাকুরদাদা ও ছোট ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে, বারিক মিয়াঁ নামক এক সম্মানিত ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে রহমত আলী রেণুবালা নামের এক বিবাহিত মেয়েকে জোরপূর্বক বিয়ে করে। এই অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যার মতো অপরাধ একেবারে হৃদয়ে রক্তক্ষরণকারী।

এভাবে চলতে থাকে এই জঘন্য সহিংসতা ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রায় ৪৫০০ হিন্দু মানুষ ফেনী সরকারি কলেজে স্থাপন করা রিফুজি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়, এবং আরও ২৫০০ হিন্দু প্রাণের ভয়ে নোয়াখালী জেলার আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়। তারা নিরাপত্তার জন্য প্রিয় মাতৃভূমি থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু তাদের পথে আরও এক বিপদ ছিল।

ভারতের ত্রিপুরায় পালানোর চেষ্টা করা হিন্দুদের ওপর মুসলিমরা আক্রমণ চালিয়ে তাদের সবকিছু লুট করে নেয়। অনেক হিন্দু মেয়ে ও শিশু চাঁদপুর, আখাউড়া রেলস্টেশনে আশ্রয় নেয়, কিন্তু সেখানে পুলিশ, আনসার ও তৌহিদি জনতা তাদেরকে ভারতের আগরতলা কিংবা কোলকাতায় পৌঁছানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তবুও, সেই অন্ধকার সময়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বেলোনিয়াতে পালিয়ে আসা প্রায় ৫,০০০ শরণার্থী নিজেদের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়।

এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মানবতা কীভাবে হারিয়ে যেতে পারে, যখন একে অপরের প্রতি সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলা হয়। ১৯৫০ সালের নোয়াখালী ও ফেনীর হত্যাকাণ্ড আমাদের সামনে একটি প্রশ্ন রেখে যায় – "মানবতা কি শুধু শব্দ, নাকি এটি সত্যি একটি অভ্যস্ত আচরণ?" সেই সময়ের নিরীহ হিন্দুদের প্রতি ঘটে যাওয়া এই অমানবিক আচরণ আজও আমাদের মর্মাহত করে।